বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রধান একটি অংশ বাস করে এ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায়।
গারো পাহাড় |
আর এসব জেলায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীগুলো হল চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, পাংখুয়া, চাক, খ্যাং, খুমি এবং লুসেই ইত্যাদি। আজকের পোস্টে থাকছে গারো জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা।
গারো নামকরণ
গারো পাহাড়ের নামানুসারে গারো নাম নাকি গারোদের নামানুসারে গারো পাহাড়ের নাম সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷ বোনার্জি (B. Bonerjea)-র তথ্যানুযায়ী গারো জনগোষ্ঠীর নামানুসারে আসামের পাহাড় শ্রেণীর নাম গারো পাহাড় (Garo Hills)৷
বাংলাদেশী নৃবিজ্ঞানী খালেক বোনার্জির তথ্য সমর্থন করে বলেন যে গারো জনগোষ্ঠীর নামানুসারে গারো পাহাড়ের নাম৷ গারো পাহাড়ের নামানুসারে গারোদের নাম নয়৷ গারোরা বন জঙ্গলে আর পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করে বিধায় সমতলবাসী বাঙালিরা তাদেরকে প্রথম থেকে গারো নামে ডাকতে শুরু করে৷
গারোরা অবশ্য নিজেদের প্রাই মান্দি বলে পরিচয় দেয়৷ মান্দি অর্থ মানুষ৷ যাই হোক গারোরা বাঙালি কর্তৃক দেওয়া গারো নামটির মোটামুটিভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে৷
গারোদের বাসস্থান
গারো সমাজের অধিকারংশই ভারতের আসাম (মেঘালয়) জেলায় এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় বসবাস করে৷ এছাড়া ঢাকা জেলার উত্তর, রংপুর জেলার উত্তর পূর্বাঞ্চলে এবং সিলেট চা বাগানে সামান্য কিছু গারো দেখতে পাওয়া যায়৷
বাংলাদেশের গারোরা মূলত পাহাড়ী গারো নয়৷ এরা সমতলী গারো বলেই পরিচিত৷ কিছু কিছু টিলা বা উঁচু ঢিবি বিশিষ্ট বনাঞ্চলে এদের বসবাস৷
গারো জনসংখ্যা
ভারতের আসাম জেলার গারো পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ২, ৩৭,৮৪২ জন গারে বসবাস করে৷ পক্ষান্তরে বাংলাদেশের মোট গারোর সংখ্যা ৮০,০০০ এর মত। এদের মধ্যে ময়মনসিংহে ৫০,০০০ এবং টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে ২০,০০০ গারো বসবাস করে।
ঢাকা, রংপুর এবং সিলেট অঞ্চল মিলে প্রায় ১০ হাজার গারো বাস করে। অতএব ভারত ও বাংলাদেশে মোট গারো জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৩,১৭,৮৪২। আর এই সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গারোদের ভাষা
এদের ভাষার স্থানীয় নাম মান্দি ভাষা বা গারো ভাষা। তবে ভাষা তাত্বিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে যে, গারোরা যে ভাষায় কথা বলে তা মূলত সিনো-টিবেটান (Sino Tibetan) ভাষার অন্তর্গত টিবেটো-বার্মান (Tibeto Burman) উপ-পরিবারের আসাম-বার্মা (মায়ানমার) শাখার অন্তর্গত বোডো বা বরা (Bodo or Bora) ভাষা উপগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। গারোদের কোন লিপি বা অক্ষর নেই। তবে বর্তমানে ভারতের গারোরা আসামাঞ্চলে গারো ভাষা লিখছে।
গারোদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়
নৃগোষ্ঠীগতভাবে (raciaily) গারোদের মঙ্গোলয়েড-ই বলা চলে। কেননা তাদের মধ্যে মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর অনেক বৈশিষ্ট্যই লক্ষ্য করা যায়। যেমন গারোদের মুখমন্ডল গোলাকৃতি এবং সমতল (flattened)। নাক প্রশস্ত এবং চ্যাপ্টা। কপাল ক্ষুদ্রাকৃতির এবং তা চোখের সামনে তেমন বেশি একটা সম্প্রসারিত নয়।
এদের কান বৃহদাকারের এবং ঠোঁট মোটা। এদের চুল সাধারণত কালো। চুল প্রায় ঢেউ খেলানো (Wavy)এবং কোকড়ানো। অবশ্য কারো কারো চুল সোজা (Straight)। পুরুষের মুখ দাড়ির পরিমাণ কম। পুরুষ ও মহিলাদের গড় উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট। গারো মেয়ে-পুরুষের গড়ন মোটামুটিভাবে হাল্কা পাতলা। তবে তারা বেশ শক্তিশালী এবং কর্মঠ।
গারোদের ধর্ম
বাংলাদেশের বর্তমান গারোদের ৯০% ধর্মান্তিরত খ্রিস্টান৷ প্রায় ২% মুসলমান ও হিন্দু বাকি প্রায় ৮% এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী ধর্মই প্রাধান্য পাচ্ছে৷ গারোদের ঐতিহাবাহী ধর্মের নাম সংসারেক৷ এর অর্থ স্পষ্ট নয়৷ গারোরাও এর অর্থ জানে না৷
তবে খালেকের মতে গারোরা যখন অন্যান্য ধর্মের সংস্পর্শে আসে তখন নিজেদের ধর্মের এক নাম দিয়ে নিয়েছে নতুবা অন্যারা তাদের ধর্মের নাম দিয়েছে সংসারেক৷ খালেক মনে করেন যে সম্ভবত বাংলা সংসার থেকে সংসারেক শব্দেটি এসেছে৷
এখানে সংসার বলতে সম্ভবত জগৎ সংসারকেই বোঝানো হচ্ছে৷ অর্থাৎ সংসার, পরিবার খানা বা জাগতিক বিষয়ই তাদের ধর্ম৷ ঐতিহ্যগতভাবে গারোরা সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী৷ তারা যে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করে তার নাম মিতে বা মাইতে। মাইতে দেব-দেবি এবং প্রেতাত্মা উভয়কে বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়৷
গারোদের মতে কিছু মাইতে দয়ালু, পরোপকারী তথা বন্ধবাৎসাল৷ অপরপক্ষে কিছু মাইতে নির্দয় এবং শক্রভাবাপন্ন৷ গারোরা উভয় ধরনের মাইতেকেই পূজা অর্চনার দ্বারা খুশী করতে চায়৷ গারোদের বিশ্বাস মাইতে জঙ্গলে এবং পাহাড়ে বসবাস করে৷ কদিপয় মাইতে আকাশেও বসবাস করে৷
তবে সব মাইতেই গারোদের গ্রামাঞ্চলে ঘোরাফেরা করে যাদেরকে তারা কখনো দেখেনি। দেখা সম্ভবও নয় বলে তারা মনে করে৷ তবে গারোদের বিশ্বাস মাইতে তাদেরকে সর্বদাই দেখছে এবং মাইতেকে পূজা দিয়ে খুশি করতে পারলে গারোদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে বলে বিশ্বাস৷
মাইতের সংখ্যা কত তা গারোরা জানে না৷ তবে খালেক কতিপয় মাইতের নাম সংগ্রহ করে তাদের কাজ ও মর্যাদার ব্যাখা দিয়েছেন৷ যেমন তাতারা (Tatara) হচ্ছে মাইতেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন৷ তাতারা নাকি পৃথিবী এবং এর মধ্যকার সব প্রাণী সৃষ্টি করেছে৷
সালজং হচ্ছে উর্বরতা দেবতা৷ সূর্য হচ্ছে সালজং এর প্রতিনিধি৷ ফসলের ভাল মন্দ এই দেবতার ওপরই নির্ভর কনে বলে তাদের বিশ্বাস৷ সুসাইম হচ্ছে গারোদের ধন দৌলতের দেবী ৷ চন্দ্র হচ্ছে এই দেবার প্রতিনিধি৷ গারো পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী সুসাইম হচ্ছে সালজং এর বোন৷
অবশ্য পরবর্তীতে সে হয় স্ত্রী। গোয়েরা হচ্ছে গারোদের শক্তি দেবতার নাম৷ কালকেম জীবন নিয়ন্ত্রণ করে বলে গারোদের বিশ্বাস৷ সে নাকি যখন খুশি কারো মৃত্যু ঘটাতে পারে৷ তবে বিভিন্ন অসুখ বিসুখের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দেব দেবি আছে৷ যেমন - নাওয়াং, পেট বেদনা, বমি এবং ডাইরিয়ার জন্য দায়ী৷
এমনি আরও দেব-দেবি রয়েছে। যারা অন্যান্য অসুখের জন্য দায়ী বলে গারোদের বিশ্বাস৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে গারোদের ৯০% খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে ৷ ব্যাপটিস্ট এবং ক্যাথোলিক মিশনারী কর্মীরা গারোদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে সমর্থ হয়েছে৷
তবে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্যাপটিস্টরা সংখ্যায় বেশি৷ পক্ষান্তরে মধুপুর গড়ে ক্যাথলিক সংখ্যাই বেশি৷ কিছু কিছু গারো অবশ্য মুসলিম হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছে৷
গারো সামাজিক সংগঠন
গারো সমাজ মূলত মাতৃসূত্রীয়। তাদের সবচেয়ে বৃহৎ মাতৃসূত্রীয় দলা বা গোত্রের নাম চাটচী। যার অর্থ হল আত্নীয় বা জ্ঞাতি। যারা চাটচী গোত্রভু্ক্ত তারা সবাই একে অপরের সঙ্গে মাতৃসূত্রীয় রীতিতে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করে৷ পাঁচ ধরনের চাটচী গোত্র রয়েছে৷
যথাঃ সাংমা, মারাক, মমিন, সিরা এবং আবেং৷ তবে খালেক বলেন যে বাংলাদেশের গারোদের মধ্যে প্রধানত প্রথম তিন ধরনের চাটচী গোত্রই লক্ষ্য করা যায়৷ প্রতিটি চাটচী গোত্রই বহির্বিবাহ রীতি মেনে চলে৷ প্রতিটি চাটচী গোত্র আবার ছোট ছোট কয়েকটি ক্ষুদ্র গোত্রে বিভক্ত যার নাম মাচং৷
মাচং গোত্রগুলোতে বহির্বিবাহ রীতি পালিত হয় এবং এরা মাতৃসূত্রীয় নীতিই অনুসরণ করে৷ মাচং নামের গোত্র সংখ্যা কত তা জানা যায় না৷ প্লেফেয়ার (Playfair) তার The Garos গ্রন্থে ১২৭টি মাচং গোত্রের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন।
প্রতিটি মাচং এর অধীনে কয়েকটি করে ক্ষুদ্র গোত্র রয়েছে যার নাম মাহারী৷ মাহারী গোত্রগুলো ক্ষুদ্রকৃতির বিধায় এর মধ্যকার সদস্যদের রক্তে সম্পর্ক নির্ণয় সহজকতার৷ মাচং এর সদস্যদের রক্ত সম্পর্ক নির্ণয় করা যায় না৷ মাহারীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে মাহারী সদস্যদের সবাই একত্র এক জায়গায় বসবাস করে৷
তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এক মাহারীর লোক অন্য গ্রামে গিয়েও বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে৷ উল্লেখ্য যে মাহারী, মাচং এবং চাটচী সবউ মাতৃসত্রীয় গোত্র এবং প্রতিটাই বহির্বিবাহ ভিত্তিক গোত্র৷
গারো সমাজের পরিচয় এবং বিবাহ ব্যবস্থা
গারো পরিবার মাতৃসূত্রীয়৷ অর্থাৎ সম্পত্তি ও বংশ নাম মাতৃধারার মাতা থেকে মেয়েতে বর্তায়৷ গারো দম্পত্তি স্ত্রীর বাারর গৃহে বসবাস করে৷ অর্থাৎ সেখানে মাতৃবাস রীতি অনুসরণ করা হয়৷ তবে ইদানিং কিছু শিক্ষিত গারো স্বামীর পিতার গৃহে বাস করে৷গারো পরিবার মাতৃপ্রধান৷ পরিবারের ক্ষমতা তাত্ত্বিকভাবে স্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত৷ পরিবারের সম্পত্তির মালিক স্ত্রী৷ তবে ব্যবস্থাপনার মালিক স্বামী৷ তাই কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে উভয়েরই যৌথ ভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। গারো সমাজে স্বামী, স্ত্রীর ওপর প্রবূত্ব খাটাতে বা নির্যাতনের কৌশল অবলম্বন করতে পারে না৷
কেননা জ্ঞাতি গোষ্ঠীর লোকজন এসব ব্যাপারে সহসাই হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনে৷ গারো সমাজ মনোগামী বা যুগল বিবাহ রীতিই বেশি রক্ষ্য করা যায়৷ তবে বহু স্ত্রী বিবাহ একেবারে অজানা নয়৷ কোন কোন স্বামী স্ত্রীর বংশের কোন পাত্রীকে বিয়ে করে থাকে৷
একজন পুরুষ গারো তার চাচাত বা খালাতো বোন বিবাহ করতে পারে না৷ অর্থাৎ বিবাহ নিষিদ্ধ৷ তাকে তার মামাতো বা ফুপাতো বোনকে বিবাহ করতে হবে৷ অর্থাৎ গারো সমাজ বিবাহ অনুমোদিত। গারোদের বিবাহ সম্পত্তির মালিকানা এবং তার উত্তরাধিকার রীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত৷
বিবাহোত্তর বসবাস রীতিও সম্পত্তি উত্তরাধিকার রীতির ওপরই নির্ভরশীল৷ একটি আদর্শ গারো পরিবারে মহিলাই সব সম্পত্তির মালিক এবং মাতা থেকে মেয়েই সম্পত্তি অর্জন করে৷ অর্থাৎ গারো পুরুষেরা সম্পত্তির মালিক নয় বা উত্তরাধিকারও নয়৷
কোন মহিলার সম্পত্তি তার যেকোন একটি কন্যাতে উত্তরাধুকািরসূত্রে বর্তায়৷ যে কন্যা মাতা থেকে সম্পত্তি অর্জন করে তাকে বলা হয় নোকনা৷ নোকনা অর্থ পরিবারের ভিত্তি৷ রীতি অনুযায়ী নোকনার বোনেরা তাদের মাতা থেকে সম্পত্তি পায়৷ যারা সম্পত্তি পায় না তাদের বলা হয় এগেট৷ এগেট অর্থ অ-উত্তরাধিকারী৷
নোকনার পিতা মাতাই নোকনার জন্য পাত্র বা স্বামী পছন্দ করে৷ নোকনার স্বামীকে বলা হয় নোকরাম৷ নোকরম অর্থ পরিবারের খুঁটি বা স্তম্ভ৷ নোকনা ও নোকরম নোকনার বাবা মার বাড়িতে বসবাস করে বা করতে হয়৷ নোকরম ও নোকনান উভয়ই নোকনার বৃদ্ধ বাবা মার সেভা যত্ন করতে বাধ্য।
অন্যদিকে এগেট ও তাদের স্বামীরা (এগেটের স্বামীকে চাওয়ারী বলা হয় যার অর্থ জামাই) এগিটের বাবা মার বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং নিজেরা বাড়ি তৈরি করতে পারলেই ভিন্ন বাড়িতে চলে যায় এবং যেতে বাধ্যও বটে৷ এগেট ও তার স্বামীরা এগেটের বাবা মার বার্ধক্যে সেবাযত্নের জন্য বাধ্য নয়৷
গারো বিয়েতে কন্যাকে কোন পণ দিতে হয় না৷ স্বামীও যৌতুক পায় না৷ বিয়েতে কোন লেনদেন নেই৷ তবে বাঙালি সমাজের প্রভাব ইদানিং কোন কোন শিক্ষত গারো স্বামী যৌতুক নিচ্ছে৷ খ্রিস্টান গারোদের বিয়ে চার্চে এবং সংসারেক গারোদের বিয়ে ঐতিহ্যবাহী নিয়মে অনুষ্ঠিত হয়৷
গারোদের বিবাহ প্রথা
গারোদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ খুবই কম৷ তবে একেবারে তা অজানা নয়৷ বিবাহবিচ্ছেদ সালিসের মাধ্যমে ঘটে৷ বিচ্ছেদে স্বামী বা স্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়৷ দোষী ব্যক্তির গোষ্ঠীর লোক অন্য পক্ষকে জরিমানা দেওয়ার শর্তে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে৷গারোদের অর্থনৈতিক অবস্থা
বাংলাদেশের গারো আগে জুম বা পালাক্রম চাষ করতে৷ জুম বা পালাক্রমে চাষে তারা প্রধানত ধান এবং নানা জাতের সবজি উৎপাদন করত৷ সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে গারোরা ১৯৫০ সালের পর থেকে আর জুম চাষ করছে না৷ এখন তারা হাল কৃষিতে অভ্যস্ত হয়েছে৷হাল কৃষির সাহায্য তারা প্রধানত ধান নানা জাতের সবজি ও আনারস উৎপাদন করছে৷ যদিও গারোরা সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসাবাস করে তথাপি জমিদার আমলে জমিদার থেকে তারা কৃষি ভূমি বন্দোবস্ত নেয় এবং কৃষি জমিতে ব্যক্তি মালিকানা বর্তমান৷
গারো সমাজ ভূ-সম্পত্তির মালিক স্ত্রী, স্বামী নয়৷ মাতৃসূত্রীয় গারো সমাজে উত্তরাধিকার রীতি মা থেকে কন্যায় বর্তায়৷ তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যে নেই একথা বলা চলে না৷ আগের দিনে গারো সমাজে আর্থিক বৈষম্য তেমন ছিল না বললেই চলে৷
ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব, বাজার তথা মুদ্রা অর্থনীতির প্রভাব ইত্যাদির ফলে গারো সমাজে ক্রমেই অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমাদের সমতলবাসী বাঙালি সমাজের তুলনায় গারোদের অর্থনৈতিক বৈষম্য নেহায়েত মামুলী৷
গারো নেতৃত্ব ও রাজনীতি
যদিও গারো সমাজে গ্রাম প্রধানের অস্তিত্ব বরাবরই ছিল। তথাপি চাকমাদের মতো গারো ট্রাইবাল প্রধান বলতে কিছু নেই৷ বস্তুত গারো সমাজে কখনই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গড়ে উঠ নি৷ গারো গ্রাম সমাজের প্রধান গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে গ্রামীণ বিচার আচার পরিচালনা করেন৷তবে গারো সমাজে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রশাসনে যন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে৷ গারো অঞ্চলেও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে৷ যার ফলে গারো নেতৃত্বে এসেছে আমুল পরিবর্তন৷
কেননা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি বা নির্বাচিত কোন মেম্বার চেযারম্যানদের ক্ষমতা ঐতিহ্যবাহী গারো গ্রাম প্রধানের চেয়ে এখন অনেক বেশি এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নেতৃত্বই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷
গারোদের শিক্ষা
বাংলাদেশের গারো সমাজের ৯০% লোকই বর্তমানের খ্রিস্টান৷ গারো অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশানারী স্কুলগুলোতে গারোরা শিক্ষালাভ করছে৷আর ঐসব স্কুলের যাবতীয় খরচ ক্রিস্টাস মিশনারীরাই বহন করে৷ তবে বাংলাদেশী গারোরা বাংলা হরফে গারো ভাষা লিখেছেন৷ বর্তমানে ২০% এরও অধিক গারো লোকই শিক্ষত বলা চলে৷
গারোদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
গারোদের বিশ্বাস দেহ থেকে আত্না বিদায় নিলেই মৃত্যু ঘটে৷ আত্না অমর৷ তাদের বিশ্বাস মৃত্যুতে আত্মা চিকমাং নামক স্থানে চলে যায়৷ চিকমাং হল মৃতের দেশ৷ তাদের বিশ্বাস গারো পাহাড়ের দক্ষিণ - পূর্বে ভারত - বাংলাদেশ সীমান্তে পাহাড়ের চূড়ায় চিকমাং অবস্থিত৷তাদের বিশ্বাস চিকমাং এ কেবল মৃতরাই যেতে পারে৷ জীবিতরা নয়৷ গারোরা মৃতদেহের গোসল দেয়৷ গোসলের পর মরদেহ মেঝেয় রেখে দেয়৷ মরদেহের মাথায় কাছে খাবার রেখে দেয়৷ আর এসবকে ঘিরে অনেক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে৷
যাহোক মৃতদেহ কমপক্ষে একদিন এক রাত ওখানের রেখে দেওয়ার পর তা কোন এক রাতে সাধারণত দ্বিতীয় রাতে, পোড়ানো হয়৷ গারো মৃতদেহ দিনের আলোয় পোড়ানোর রীতি নেই৷ মৃতদেহ পোড়ানোর ছাই জঙ্গল নিয়ে ফেলে দেয়৷ হাড়গুলো মাটির পাত্রে তুলে মৃতের বাড়ি কাছে মাটির গর্তে পুতে রাখে৷