বনভূমির লতাগুল্ম বৃক্ষরাজি ও বন্যপ্রাণী নিয়ে বনজ সম্পদ গঠিত৷ এ বনজ সম্পদ একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ৷ বনভূমির এসব গাছপালা ও বন্য প্রাণীর মধ্যে নিবিড় আন্তঃসম্পর্ক বিরাজমান৷ কোন কারণে এর যে কোন একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যগুলোও আপনা আপনি ধ্বংস হয়ে যায়৷ কোন অঞ্চলে কারণে এর যে কোন একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যগুলোও আপনা আপনি ধ্বংস হয়ে যায়৷
বন |
কোন অঞ্চলে নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি বা সরকারি বনাঞ্চল থেকে গাছ কাটা অপসারণ পরিবহন ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধান রয়েছে৷ এসব আইন বা বিধানকে বন বিধি বা বন আইন বলা হয়৷ বনভূমির সকল সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য এ উপমহাদেশে ১৯২৭ সালে বন সংরক্ষণ আইন করা হয় যা বন আইন ১৯২৭ নামে পরিচিত৷
পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে এ আইনের বিভিন্ন সংশোধনী আনয়ন করে যা বন আইন (সংশোধন) ১৯৯০ নামে পরিচিত৷ এ আইনের পর অবৈধ বন ধ্বংসের প্রবণতা কমে বটে কিন্তু পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হয় না৷ সুতরাং ১৯৯০ সালের এ আইনকে সময় উপযোগী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়৷
ফলুশ্রুতিতে ১৯৯৫ সালে এ আইনের আরও কিছু সংশোধনী আনা হয়৷ এ আইনে বলে বনজ সম্পদ সংরক্ষণের জন্য কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে৷ এসব বিধিনিষেধ লঙ্ঘনের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে৷ এ ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার বনবিধি বলে আরও যা করতে পারবেন তাহলোঃ
- সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে কোন বনভূমিতে সংরক্ষিত বন গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন৷
- এ প্রজ্ঞাপন বলে ক্ষতিগ্রস্ত বক্তি বা অন্যকোন দাবিদার প্রজ্ঞাপন প্রকাশের তারিখ হতে ন্যূনতম তিনমাস এবং অনধিক চার মানের মধ্যে বন কর্মকর্তার নিকট লিখিতভাবে নিজে হাজির হয়ে ক্ষতির বিস্তারিত উল্লেখ করে আবেদন করতে পারবেন৷
- সরকার একইভাবে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট তারিখ হতে সংরক্ষিত কোন বন বা তার অংশ বিশেষ সংরক্ষিত রহিত এ মর্মে নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন৷
বনবিধির বর্ণনা?
চলুন আমরা এবার বন সংরক্ষণের প্রচলিত আইনের উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ জেনে নেই৷ এ বিধি বলে নিম্নলিখিত কাজসমূহ দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে যেমনঃ- যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত সরকারি বনভূমি থেকে গাছপালা ও অন্যান্য বনজ সম্পদ আহরণ করা৷
- অনুমতি ব্যতীত আধাসরকারি বা স্থানীয় সরকারি জমি বা স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা বা কোন ব্যক্তির নিজস্ব জমি বা বাগান হতে কাঠ বা অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে নিজ জেলার যে কোন স্থানে প্রেরণ৷
- যথাযথ কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে সরকারি বনাঞ্চলে প্রবেশ করা বনভূমিতে ঘরবাড়ি ও চাষাবাদ করে বনাঞ্চলের ক্ষতিসাধন করা৷
- বনাঞ্চলে গবাদিপশু চরানো৷
- প্রয়োজনীয় অনুমতি ব্যতীত বনের গাছ কাটা অপসারণ ও পরিবহন করা৷
- যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ঋতু ব্যতীত অন্য সময়ে আগুন জ্বালানো আগুন রাখা বা বহন করা৷
- বনোর কাঠ কাটার অথবা কাঠ অপসারণের সময় অসাধারনতাবশত বনের ক্ষতিসাধন করা গাছ ছেটে ফেলা ছিদ্র করা বাকল তোলা পাতা ছেড়া পুড়িয়ে ফেলা অথবা অন্য কোন প্রকারে বৃক্ষের ক্ষতিসাধন করা৷
- বনে শিকার করা গুলি করা মাছ ধরা পানি বিষাক্ত করা অথবা বনে ফাঁদ পাতা
- বনজ দ্রব্যাদি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অপসারণ পরিবহন ও হস্তান্তর করা৷ বন কর্মকর্তা অথবা বনে রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত ব্যক্তির কাজে বাধা প্রধান করা৷
- যথাযথ অনুমতি ব্যতীত বনের মধ্যে গর্ত খোড়া চুন বা কাঠ কয়লা পোড়ানো অথবা কাঠ ব্যতীত অন্য কোন বনজাত পণ্য সংগ্রহ করা অথবা শিল্পজাত দ্রব্য প্রক্রিয়াজাত করা অপসারণ করা৷
- বিভাগীয় বন কর্মকর্তার পূর্বানুমতি ব্যতীত কোন সংরক্ষিত বনে আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রবেশ করা।
বন আইন লঙ্ঘনের শাস্তির বিধান কি?
বন আইন লঙ্ঘনের বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে৷ উপরোক্ত আইন ভঙ্গের জন্য ন্যূনতম ছয় মাসের জেলসহ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেলসহ পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে৷ এসব অপরাধের বিচার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হয়ে থাকে।বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিধি কি কি?
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে একটি প্রণয়ন করেন যা বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ ১৯৭৩ নামে অভিহিত৷ এ আইন বলে বিনা অনুমতিতে যে কোন উপায়ে বনাঞ্চলে বন্যপ্রাণী শিকার বা হত্যা করা বন্যপ্রাণী প্রজননে বিঘ্ন সৃষ্টি জাতীয় উদ্যানের সীমানার এক মাইলের মধ্যে কোন প্রাণী শিকার বিদেশি প্রাণী আমদানি বা বিদেশে রপ্তানি করা প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে৷এ আইন লঙ্ঘন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিধি লঙ্ঘনকারীকে আদালত ছয় মাসের জেলসহ পাঁচশত টাকা জরিমানা এবং সর্বোচ্চ দুই বৎসরের জেলসহ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন৷ এ আইন ভঙ্গকারীকে আর্থিক জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে জেলে দেওয়ার বিধান রয়েছে৷ তবে মানুষের জীবন বাঁচাতে ফসলের ক্ষতি রোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী শিকার বা হত্যা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়৷
বন সংরক্ষণ বিধির প্রয়োজনীয়তা?
দেশের বিরাজমান বন সংরক্ষণ ও নতুন বন সৃষ্টি করে দেশে বনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি৷ কারল বন পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখে৷ কিন্তু আমাদের দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি৷ এ অধিক জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য সীমিত বনজসম্পদের উপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে৷প্রাত্যহিক চাহিদা মেটানোর জন্য মানুষ বনের বৃক্ষরাজি ও বন্য প্রাণী উজাড় করছে৷ বন ধ্বংস হওয়ার কারণে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রজনন বিঘ্নিত হচ্ছে খাদ্য সংকট হচ্ছে৷ অবৈধ শিকারির কবলে পড়েও বন্য প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে৷ বনে অবৈধ অনুপ্রবেশ বাড়ছে৷ বনজসম্পদ চুরি ও পাচার করে এক শ্রেণির অসাধু লোক বন ধ্বংস করছে৷
বনের নিকটবর্তী এলাকাবাসী ধীরে ধীরে বন দখল করছে৷ বন এলাকায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করছে৷ অসাধু চক্র পার্বত্য এলাকার পাহাড় কেটে কাঠ পাচার করে পাহাড়ি বন ধ্বংস করছে৷ এ ছাড়াও সৃজিত সামাজিক বনের বৃক্ষরাজি আত্মসাৎ করছে৷ এর ফলে ভূমিক্ষয় ভূমি ধ্বংসসহ নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে৷
দেশ পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ বনসম্পদকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে বন সংরক্ষণ বিধি প্রণীত হয়েছে৷ এ বিধির কার্যকরী প্রয়োগে সরকারিভাবে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে৷ বনবিধি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জনসংযোগ বাড়াতে হবে৷ বন সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিধি বাস্তবায়িত হলে অনেক সুফল পাওয়া যেতে পারে৷