জামদানি শাড়ি কিনতে চাচ্ছেন কিন্তু জামদানি শাড়ি চেনার উপায় জানেন না তা কি করে হয় বলেন। বর্তমান সময় বাজারে নকল জামদানিতে সয়লাভ। এর কারণে আসল জামদানি চেনার উপায় জানা থাকলে জামদানি কিনে যেমন লাভ হবে। তেমনিভাবে ব্যবহার করেও শান্তি পাবেন।
জামদানি শাড়ি আমাদের দেশের ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। নান্দনিক ডিজাইন এর কারণে জামদানিকে আভিজাত্য ও রুচিশীলতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
জামদানি শাড়ি |
শাড়ি পছন্দ করেন যেসব নারীরা তাদের পছন্দের তালিকায় জামদানি শীর্ষে রয়েছে। জামদানিকে শুধু শাড়ি বললে আসলে ভুল হবে। এটি এমন একটি শিল্প যা শুধুমাত্র একটি দেশের ভৌগোলিক পরিবেশে তৈরি হয়। একজন তাঁতি তার সুনিপুন দক্ষতায় এ শাড়ি তৈরি করে থাকেন।
তাই জামদানির এই ঐতিহ্যবাহী নকশায় ও সুনিপুন বুননের কারণে ২০১৬ সালে ইউনেস্কো একে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জামদানির নকশা ও বুননের উপর ভিত্তি করে এটি আসল না নকল তা চেনা যায়। চলুন আজকের পোস্টটি শুরু করা যাক।
জামদানি শাড়ি কি?
ধারণা করা হয় ফার্সি শব্দ থেকে জামদানি এসেছ। আর কার্পাস তুলা দিয়ে তৈরি করা শাড়িকে সাধারণত জামদানির শাড়ি বলা হয়। জামদানি শাড়ির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল এটা বয়নে ৭০-৮০ কাউন্টের সূতা ব্যবহার করা হয়। ৩য় সুতা দিয়ে জামদানিতে নকশা করা হয়ে থাকে।জামদানি শাড়ির গঠন?
জামদানি শাড়ির দৈর্ঘ্য সাধারণত হতে হবে ১২ হাত অথবা ১৮ ফুট। আর প্রস্থে ৪৫ ইঞ্চি হতে হবে। জামদানি শাড়ি কেনার আগে অবশ্যই সুতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। নকল জামদানি শাড়িতে সিল্কের সুতার পরিবর্তে পলিস্টার সুতা অথবা নাইলনের সুতা ব্যবহার করা হয়।আরও জানুনঃ
- বাংলার মসলিন বিখ্যাত কেন?
- জেনে নিন স্টেনটার মেশিনের কাজ | স্টেনটার মেশিন চালানোর নিয়ম
- জেনে নিন স্টেনটার মেশিন কত প্রকার | স্টেনটার মেশিনে কাজ
আর এ সুতা ধরে টান দিলে সুতাগুলো কুচঁকে যাবে। আর যদি সিল্ক সুতা থাকে। তবে সেটা হবে অমসৃণ। কারণ সেটায় মাড় দেয়া থাকে। সুতা যদি খাঁটি সিল্ক হয়ে থাকে। তবে সে সুতা ধরে টান দিলে সেটা ছিঁড়ে যাবে।
আর এই সুতা আগুনে পোড়ালে চুলের মতো পোড়া গন্ধ বের হবে। তাই বলা যায় জামদানি শাড়ি চেনার উপায় হিসাবে এই বিষয়গুলো অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
জামদানি শাড়ি কত প্রকার?
জামদানি শাড়ি বিভিন্ন প্রকারের হয়। তবে উপাদান অনুসারে সাধারণত একে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়ঃ- হাফ সিল্ক জামদানি
- ফুল কটন জামদানি
- ফুল সিল্ক জামদানি
হাফ সিল্ক জামদানি কি?
হাফ সিল্ক জামদানি শাড়িতে সাধারণত দুই ধরনের সুতা থাকে। এর লম্বালম্বি সুতাগুলো হয় তুলার ও আড়াআড়ি সুতাগুলো হয় রেশমী সুতার।ফুল কটন জামদানি কি?
ফুল কটন জামদানি শাড়ির সম্পূর্ণ সুতা তুলার তৈরি হয়।ফুল সিল্ক জামদানি কি?
ফুল সিল্ক জামদানি শাড়িতে দুই দিকের সুতাগুলোই রেশমী সুতার হয়ে থাকে।জামদানি শাড়ি কোথায় তৈরি হয়?
জামদানি শাড়ি কোথায় তৈরি হয় ঢাকার ডেমরা জামদানি পল্লী ও ঢাকার মিরপুর জামদানি পল্লীতে।জামদানি শাড়ির নকশা?
জামদানি শাড়ির বৈচিত্র্য ফুটে উঠে এর নকশার মাধ্যমে। এই নকশা গুলো বিভিন্ন ধরনের হয়। জামদানী শাড়ির কিছু পরিচিত নকশার নাম হলঃময়ুরপাখা, বলিহার, পান্না হাজার, পানসী, বটপাতা, জলপাড়, জবাফুল, করোলা, তেরছা, দুবলা জাল, কলকাপাড়, কটিহার ইত্যাদি। ছোট ছোট ফুল, লতাপাতার বুটি এগুলা যদি জমিনে জালের মতো থাকে তবে তাকে বলে জালার নকশা।
জামদানি শাড়িতে যদি ছোট ফুল অথবা লতাপাতার ডিজাইন তেরছাভাবে থাকে তাহলে তাকে তেরছা জামদানি বলা হয়।
জামদানি শাড়িতে যদি ডোরাকাটা নকশা থাকলে তাকে বলে ডুরিয়া জামদানি। আবার পাড়ে যদি কলকির নকশা থাকে সেই পাড়কে কলকাপাড় বলে।
জামদানি শাড়ি চেনার উপায়?
আসল জামদানি শাড়ি গুলো হাতে বোনা হয়ে থাকে। তাই এর ডিজাইন হয় খুব সূক্ষ্ণ ও নিখুঁত হয়ে থাকে। এবং ডিজাইনগুলো হয় খুবই মসৃণ। আর জামদানি শাড়ি চেনার উপায় হিসাবে এই কৌশলটি বেশ কার্যকরী হয়। আসল জামদানি শাড়ি চেনার উপায় হল জামদানি শাড়ি তৈরি করার সময় তাতিঁরা একটি একটি করে সুতা হাতের সাহায্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুনন করে থাকেন।তাই শাড়িতে সুতার কোন অংশ বের হয়ে থাকে না। আর ঠিক এই কারণে জামদানি শাড়িতে উল্টা পিঠ তেমন বুঝা যায় না। তাই এর সামনের অংশ এবং পেছনের অংশ প্রায় একই রকম হয়ে থাকে। পার্থক্য বের করা বেশ কঠিন হয়। যে শাড়ি মেশিনে বোনা হয় সেটায় শুধুমাত্র জামদানির একটা অনুকরণে হুবহু একটা নকশা এঁকে দেওয়া হয়। আর মেশিনে বোনা শাড়িতে উল্টো দিকটা খুব সহজেই বুঝা যায়।
কারণ এতে উল্টা দিকের সুতা কাটাকাটা অবস্থায় বের হয়ে থাকে। আসল জামদানি শাড়ি বুননে সুতি ও সিল্ক সুতা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। জামদানি শাড়ি কেনার সময় সুতার গুণগত মান যাচাই করতে হবে। আর সুতার কাউন্ট দিয়েই সুতার মান বুঝা যায়। যে সুতার কাউন্ট যত বেশি সেই সুতা তত বেশি চিকন হয়। তাই সুতা যত বেশি চিকন হবে, সেই জামদানি শাড়ির কাজ তত বেশি সূক্ষ্ণ হবে।
কাজ যত বেশি সূক্ষ্ণ হবে সেটি তত বেশি উন্নত মানের শাড়ি হবে। এই কাপড়ের সুতা সাধারণত ৩২-২৫০ কাউন্টের হয়ে থাকে। অন্যদিকে মেশিনে বোনা শাড়িগুলোর সুতা মাত্র ২৪-৪০ কাউন্টের হয়। জামদানি শাড়ির মান মূলত শাড়ির কাজের সূক্ষ্ণতার উপর নির্ভর করে। শাড়ি কতটা সুন্দর ও সূক্ষ্ণ হবে তা নির্ভর করে সুতা ও তাতিঁর দক্ষতার উপর। শাড়ির দাম নির্ভর করে শাড়ির কাজের উপর।
যে শাড়িতে যত বেশি কাজ করা থাকে। সেটির দাম তত বেশি হবে। আবার সুতা বেশি চিকন হলে সেই শাড়ি বুনতে সময় বেশি লাগে। তাই সে শাড়ির দাম ও বেশি হয়ে থাকে। দুইজন তাঁতি যদি একটি জামদানি তৈরি করতে চান তবে দৈনিক ১২ ঘন্টা থেকে ১৪ ঘন্টা করে কাজ করেন। তাহলে শাড়ির ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ একটি শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগবে এক সপ্তাহ থেকে ছয় মাস।
তাছাড়া শাড়ি তৈরি করার সময় সুতার মান ও কাজের ধরণ অনুযায়ী একটি জামদানি শাড়ির দাম হতে পারে ২০০০ টাকা থেকে ১,২০,০০০ টাকা। অথবা তার থেকে ও কম ও বেশি হতে পারে। কিন্তু মেশিনে বোনা জামদানি শাড়ির ক্ষেত্রে এত সময় লাগে না। তাই মেশিনে বোনা শাড়ি এক সপ্তাহে তৈরি হয় ৮ থেকে ১০ টা।
তাই এর দাম ও তুলনামূলক অনেক কম হয়।জামদানি শাড়ি চেনার উপায় হল, জামদানি শাড়িতে শুরুতে সাড়ে পাঁচ হাত পর্যন্ত কোন পাড় বোনা থাকবে না। অর্থাৎ শাড়ির যে অংশটুকু কোমরে গুঁজে রাখা হয়। সেখানে কোন ধরনের পাড় থাকে না। কিন্তু মেশিনে বোনা শাড়ি গুলোতে পুরো শাড়িতেই পাড় থাকে। জামদানি শাড়ি চেনার উপায় হল হাতে বোনা জামদানি শাড়ির ওজন হালকা হয়।
এবং শাড়ি পড়তেও খুব বেশি আরামদায়ক। মেশিনে বোনা শাড়ি গুলো নাইলনের সুতায় তৈরি করা হয় বলে এগুলো ভারি ও খসখসে হয়। মেশিনে বোনা জামদানি শাড়িগুলো দুই একবার পড়ার পড়েই নেতিয়ে যায়। পড়ার পর কিছু দিনের মধ্যে কুচকে যায়। পড়েও তেমন আরাম পাওয়া যায় না। তবে এ শাড়িগুলো অনেক বছর পড়া যায়।
জামদানি শাড়ি খুব যত্ন করে রাখতে হবে। নয়তো বেশিদিন টিক সই হবে না। একটি আসল জামদানি শাড়ি অনেক বছর ভাল থাকে। রং যদি একটু অনুজ্জ্বল হয়ে যায় অথবা কোন ভাবে যদি ফেসে যায়। তাহলে কাটা পলিশ করে নিলে আবার নতুনের মতো হয়।