বাংলার লোকশিল্প পরিমণ্ডলে বস্ত্র জগতে মসলিনের পরেই জামদানি। বুনন তাঁতে বুটি তোলা মসলিনের নাম জামদানি। আভিধানিক অর্থে জাম অর্থে একপ্রকার মদ এবং দানি অর্থে পেয়ালা অর্থাৎ বঙ্গানুবাদ অথবা ভাবানুবাদ মদের পেয়ালা শব্দ দুটি ফারসী।
আবার ফারসি শব্দ জামা অর্থ কাপড় এবং দানি অর্থে বুটিদার, সংযোগে জামদানী বুটিদার কাপড়, বোধকরি বুটিতোলা মসলিনের অপভ্রংশ হিসেবে আলোচ্য জামদানি নামকরণ হতে পারে।
জামদানি শাড়ি |
বর্তমানে লোকশিল্প জগতে জামদানী বস্ত্র একটি শৌখিনতার প্রতীক। জেমস টেলর তার রচিত টপোগ্রাফি অব ঢ়াকা গ্রন্থে বলেন সম্ভবত মুসলমানরাই জামদানির বুনন অধিকতর প্রচলিত করেন এবং এখনো (১৮৪০) তাদের হাতে এ শিল্প একচেটিয়াভাবে সীমাবদ্ধ আছে।
মসলিনের পরেই জামদানী বস্ত্রের সুখ্যাতি ছিল বলে একাধিক প্রমান পাওয়া যায়। মসলিন, মলমল বা মখমল খাস ছিল প্রসিদ্ধ নাম। মসলিনের বয়নপ্রণালি হিসেবে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল যেমনঃ প্লেন সমলিন, ডুবিয়া বা ডোরাকাটা সমলিন, চারখানা বা চেক সমলিন, হাতে বুটি তোলা, কাসিদা ও চিকন এবং তাঁতে বুটি তোলা সমলিনই হল জামদানী।
যেমনঃ তুলা থেকে সুতা তৈরি করে ও সেই সুতাকে নানারকম ভাবে ভিজিয়ে শুকিয়ে মাড় দেওয়ার পর উপযোগীকরণ করা হলে কাপড় তৈরির পরও কতগুলো প্রক্রিয়ায় কাপড়ের যত্ন নেয়া ইত্যাদি সবকিছু সমলিন তৈরির মূল পদ্ধতিগুলো জামদানী বস্ত্রে প্রক্রিয়াকরণে চলমান ছিল।
তাই এ বস্ত্রে সেসময়ে অনায়াসে মসলিনের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত ছিল। জামদানীর নকশা বুট তাঁতে রেখেই তোলা হয়। ১৭৮০ সময়কালে জামদানী দেখতে চাইলে জাদুঘরে যেতে হত। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে তৈরি কয়েকটি জামদানী সংরক্ষিত রয়েছে। ১৯০২-০৩ সালে দিল্লির প্রদর্শনীতে ঢ়াকার চারটি জামদানী প্রদর্শিত হয়েছিল।
আর এই চারখানার মধ্যে শেখ মাতাদির তেসরি নকশার জামদানীর মূল্য ছিল ৩৫৭ টাকা। এছাড়াও তখন জামদানী সম্পর্কে বহুবিধ কাহিনী, কল্পকাহিনী এবং বিখ্যাত লেখকদের কথা ও মন্তব্য রয়েছে, যার দুই বা একটি উল্লেখ করা যেতে পারে যেমনঃ
ওয়াটসন বলেন জটিল নমুনার জন্য এ বস্ত্র ঢ়াকার তাঁতিদের সবচেয়ে অধিক ব্যয়বহুল বস্ত্র জামদানীর কারিগরি অবস্থানও ছিল বয়ন শিল্পীদের শীর্ষে। বাদশাহ আওরঙ্গজেব ছিলেন জামদানীর বিশেষ গুণগ্রাহী, তার জন্য প্রত্যকটি বস্ত্রের সে সময়ে মূল্য ছিল ৩১ পাউন্ড।
আর মুর্শিদাবাদের নবাবরাও জামদানীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে একখন্ড জামদানীর মূল্য ৫৬ পাউন্ড পর্যন্ত উঠেছিল। নায়েব নাজিম মোহাম্মদ রেজা খাঁ প্রত্যেকটি জামদানীর মূল্য ছিল ৪৫০ টাকা হিসেবে পরিশোধ করতেন। এরপর নবাব জাফর আলী খাঁ বাদশা আওরঙ্গজেবের জন্য প্রতি বছর নজরানা হিসেবে যেসব শিল্পসম্ভার পাঠাতেন তাতে বাদশাহর জামদানী প্রাতির পরিচয় পাওয়া যায়।
তাছাড়া জামদানীর জৌলুশ হ্রাস পেলেও হারিয়ে যায়নি মর্মে প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার মহারাজা ও অন্যান্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্য প্রত্যেকটি ২০০ টাকা মূল্যের কয়েকটি জামদানী ঢ়াকায় তৈরি হতো। এমনকি ৪০০ টাকার মূল্যের মসলিনও মাঝে মধ্যে তৈরি হতো।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে নিখিল ভারত শিল্প প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন ৪০০ টাকা দামের জামদানী শাড়ি। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন জাদুঘর, কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, ভারতের কেলিকো মিউজিয়াম অব টেক্সটাইল, আহমেদাবাদ, কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়াম, ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া আলবার্ট মিউজিয়ামে ঢ়াকার জামদানী শাড়ি সংরক্ষিত রয়েছে।
বর্তমানে বিসিক এই জামদানী প্রযুক্তি সংরক্ষণের জন্য বহুবিধ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আর বর্তমানে ঢ়াকার মিরপুরে বেনারসি পল্লীতে জামদানী তৈরি করা হয়।