রেশমের ইতিহাস?

রেশম মথ
রেশম মথ

রেশম কি?
রেশম একটি পলি পেপটাইড তন্তু।

রেশম কোন এসিডের সমন্বয় গঠিত?
রেশম চারটি অ্যামিনো এসিডের সমন্বয়ে গঠিত। অ্যামিনো এসিডগুলো হলোঃ গ্লাইসিন (C₂H₅NO₂), অ্যালানিন (C3H7NO2), সেরিন (C3H7NO3) এবং টাইরোসিন (C9H11NO3)। 

রেশমের মধ্যে গ্লাইসিন (Glycine) এবং অ্যালানিন (Alanine) প্রায় ২:১ অনুপাতে বিদ্যমান থাকে। গ্লাইসিন এবং অ্যালানিন সিল্কের কেলাসন অঞ্চলে থাকে। আর অদানাদার অঞ্চলে সেরিন ও টাইরোসিন উপস্থিত থাকে।

রেশমের বৈশিষ্ট্য?

  • রেশম ইলাস্টিকধর্মী।
  • এর নিজের আকার ধরে রাখার ক্ষমতা আছে।
  • এটি তাপ অপরিবাহী এবং অধিক তাপ সংবেদী।
  • এর শোষণ ক্ষমতা অধিক।

রেশমের ব্যবহার?

  • প্যারাসুট তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়।
  • বিভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
  • সার্জিক্যাল সুতা তৈরি হয় রেশম হতে।
  • সুতা এবং ফিতা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
  • গৃহসজ্জায় এটি ব্যবহৃত হয়।

রেশম কি ধরনের তন্তু?
রেশম এক ধরনের প্রাকৃতিক প্রোটিন তন্তু, যার কয়েকটি ধরণ বস্ত্রশিল্প বয়নের কাজে ব্যবহার করা হয়। রেশমের সর্বাধিক পরিচিত ধরন বম্বিক্স মোরি নামের রেশম পোকার লার্ভার গুটি থেকে সংগ্রহ করা হয়।

এক ধরণের রেশম পোকার গুটি থেকে এ ধরণের সুতা পাওয়া যায়। বিশেষ ব্যবস্থায় রেশম পোকা চাষের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে এই সুতা প্রস্তুত করা হয়। 

রেশম পোকার গুটি চাষের পদ্ধতিকে কি বলা হয়?
রেশম পোকার গুটি চাষের পদ্ধতিকে সেরিকালচার বলা হয়।

রেশমের ইতিহাস?

চীনে প্রাচীনকালে সর্বপ্রথম রেশমগুটির চাষ করা হয়। রেশমের জন্য চীনের সম্রাটের স্ত্রী লেই চু এর অনেক ভূমিকা রয়েছে। 

সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৩,৫০০ আগে থেকেই চীনারা রেশমের ব্যবহার করতে জানতো। প্রথম দিকে রেশমের জামা চীনা সম্রাটের জন্য সংরক্ষণ করা হতো।

পরে এটি সে সময় সামাজের ধনী শ্রেণীর তোষা খানাতে স্থান পায় এবং এর সৌন্দর্য্য ও হালকা গুণগত মানের জন্য পরে এটি চীনা ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 

রেশমের ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে এটি একটি আন্তজার্তিক ব্যবসায় পরিণত হয় এবং একে শিল্পায়ন ভাবে চাষ করা শুরু হয়। 

চীনা সম্রাটরা রেশম গুটির চাষের উৎপাদন পদ্ধতি গোপনা রাখার জন্য অনেক সর্তকতা অবলম্বন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে রেশমের চাষ পরে জাপান, কোরিয়া এবং ভারতে আবির্ভূত হতে শুরু হয়।

রেশম বাণিজ্যের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় মিশরের ২১তম রাজবংশের (সি. ১০৭০ খ্রিস্টপূর্ব) একটি মমির চুলে পাওয়া রেশম থেকে।

ইউরোপে যদিও রোমান সাম্রাজ্য রেশমের চাষ জানাতো এবং সমাদর করতো, কিন্তু শুধু খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ বাইজেন্টাইন সাম্রাজের সময় রেশমগুটির চাষ শুরু হয়েছে।

উপকথা কথা থেকে জানা যায় যে, সন্ন্যাসীদের আদেশে সম্রাট জাস্টেনিয়ান প্রথম কন্সটান্টিনোপলতে রেশম পোকা ডিমগুলো আনে। পরে ১২০০ খ্রিস্টাব্দে ইতালির পালেরমো, কাতানযারো এবং কোমো ছিল ইউরোপের সর্বাধিক রেশম উৎপাদন শহর।

বাংলাদেশে রেশম চাষ?
রেশম চাষের সাথে আমাদের দেশের মানুষ অনেক কাল ধরেই পরিচিত। অল্প পরিমাণ জমিতে তুঁত চাষ করে পশু পালনের মাধ্যমে রেশম গুটি উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশের যেসব উঁচু স্থানে তুঁত গাছ জন্মানো যায় সেসব স্থানে রেশমকীট জন্মানো যাবে। 

এদেশের প্রায় যে কোন আবহাওয়া ও তাপমাত্রায় রেশমকীট পালন করা যায়। তবে ২১০°-২৯০° তাপমাত্রা এবং ৯০% বায়ুর আর্দ্রতা রেশম চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। আবহাওয়া ও উর্বর মাটির জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি রেশম চাষ হয়। 

এছাড়া নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর ও সিলেটে রেশম পোকার চাষ করা হয়।

তুঁত গাছ বিভিন্ন জাতের হয়ে থাকে এবং নাম ভিন্ন। বাংলাদেশের রেশম পোকারা যে তুঁত গাছের পাতা খায় তার নাম মোরাস অ্যালভা ( Morus alba)।

রেশমকীট এর জীবন?

রেশম পোকার জীবনে চারটি পর্যায় তা হল যথাঃ
  • ডিম
  • শূককীট
  • মূককীট ও 
  • পূণাঙ্গ পোকা
পূর্ণাঙ্গ পোকার নাম মথ। পোকারা নিশাচর অর্থাৎ রাতের বেলায় চলাফেরা করে। 

পোকার রঙ উজ্জ্বল নয়। স্ত্রী মথ পাতা বা কাগজের উপর চরে বেড়ায়। মথ কাগজ বা পাতায় ৪০০-৫০০ শ ডিম পাড়ে। ডিমের রঙ ফ্যাকাশে হলুদ। 

প্রায় ১০ দিন পর ডিম ফুটে শূককীট বের হয়। শূককীট দুষ্টু ছেলের মত চঞ্চল। সে বেজায় ছুটোছুটি করে আর গ্রোগাসে গিলতে থাকে। তুঁত গাছের পাতা কুচি কুচি করে কেটে এদের খেতে দিতে হয়। শূককীট কয়দিন পর পর চারবার খোলস বদলায়। খোলস বদলালনোকে মোল্টিং বলে।

মোল্টিং অর্থ ত্বক পরিবর্তন। শূককীট বড় হলে বাদামী লাল রঙের দেখায়। শূককীট চতুর্থবার খোলস বদলানোর পর মূককীটে পরিণত হতে শুরু করে। 

এ সময় এদের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শূককীট, মূককীটকে যে বাঁশের ডালায় গলা হয় তার নাম চন্দ্রকী। চন্দ্রকীতে অনেক গুলো কুঠুরি থাকে।

শূককীট দেহের ভিতরে একটি লম্বা রেশম গ্রন্থি থাকে। গ্রন্থিতে থাকে এক প্রকার রস। নালী দিয়ে এ রস মুখের বাইরে আসে। নালীর নাম স্পিনারেট (Spinneret)।

বাতাসের সংস্পর্শে রস শক্ত হয়ে যায়। মূককীট মিনিটে ৬৫ বার মুখ ঘুরিয়ে রস দিয়ে দেহের চারপাশে আবরণ তৈরি করে। এই রসকে সাধারণ কথায় মুখের লালা বলে। 

আবরণসহ মূককীটকে গুটি বলে। গুটির ইংরেজি নাম কুকুন (Cocoon)। গুটির মধ্যে মুককীটের অদ্ভুত রূপান্তর ঘটে। এই পরিবর্তনকে মেটামরফসিস (Metamorphosis) বলে।

মূককীট পরিবর্তিত হয়ে সুন্দর মথের রূপ ধারণ করে। মথই রেশম পোকার পূর্ণাঙ্গ অবস্থা।

মথ হবার আগেই গুটিকে বাষ্প বা গরম জলে রাখতে হয় । না হলে মথ গুটি কেটে বেরিয়ে যায়। গুটি কেটে গেলে সুতা নষ্ট হয়ে যায়। 

গুটি গরম পানিতে পড়লে এর সুতার জট খুলে যায়। একটি গুটিতে ৪০০-৫০০ গজ সুতা থাকে। প্রায় ২৫০০০ গুটি থেকে ১ পাউন্ড সুতা পাওয়া যায়।

রেশমের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণটা কী? 
একটা বিষয় হচ্ছে, আঠাহীন করা বা ফাইব্রয়েনের ওপর যে সেরিসিনের প্রলেপ থাকে তা সরিয়ে ফেলা। যে রেশমকে আঠাহীন করা হয়নি সেগুলোকে খসখসে বলে মনে হয় এবং রং করা বেশ মুশকিল। রেশম কাপড়ে খসখসে বুনন রয়েছে কারণ তাতে কিছুটা সেরিসিন রয়েই যায়।

দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে সুতাটাকে কত বার পাকানো বা প্যাঁচানো হয়। জাপানি হাবুতায়ে সুতা নরম ও মসৃণ। এতে কোনো ফোল্ড বা ভাঁজ নেই বা থাকলেও সামান্য। 

এর বিপরীতে ক্রেপ কাপড় কুঁচকানো ও ভাঁজযুক্ত। এটা অনেকবার প্যাঁচানো হয়। রং করা হচ্ছে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। রেশমি সুতাতে রং করা বেশ সহজ। 

ফাইব্রয়েনের গঠনের কারণে রং খুব গভীরে যায় ও এর ফলে ধোয়ার পরও রং অক্ষুণ্ণ থাকে। এছাড়া সিনথেটিক তন্তুর বৈসাদৃশ্যে রেশমে পজেটিভ ও নেগেটিভ উভয় আয়নই রয়েছে অর্থাৎ যেকোন রংই রেশমে পাকা হবে। 

রেশম সুতা তাঁতে বোনার আগেই বা পরে সহজে রং করা যায়। রেশমি কাপড় বোনার পর, কিমোনোর বিখ্যাত ইয়ুজেন রং করার পদ্ধতিতে সুন্দর করে নকশা আঁকা হয় এবং হাতে রং করা হয়।

যদিও এখন চিন ও ভারতের মতো দেশগুলোতে অধিকাংশ রেশমি কাপড় উৎপাদন করা হয় কিন্তু ফ্রান্স ও ইতালির ফ্যাশন ডিজাইনাররা এখনও রেশমি কাপড় তৈরিতে এগিয়ে রয়েছে।

অবশ্য আজকে পোশাক বানানোর জন্য অনেক সস্তা কাপড়ে রেয়ন ও নাইলনের মতো কৃত্রিম সুতা ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু তবুও রেশমের কোনো বিকল্প নেই। 

বিজ্ঞানের বর্তমান অগ্রগতি সত্ত্বেও, সংশ্লেষণ পদ্ধতিতে রেশম উৎপন্ন করা যায় না। জাপানের ইয়োকোহামার রেশম জাদুঘরের পরিচালক বলেন আমরা এর আণবিক সংকেত থেকে শুরু করে গঠন পর্যন্ত সবকিছুই জানি। কিন্তু আমরা এটা হুবহু তৈরি করতে পারি না।

রেশমি সুতো কিভাবে তৈরি হয়?
একটা কোকুন থেকে রেশমের প্যাঁচ খুলে একটা রিলে আবার প্যাঁচানোর পদ্ধতিকে রিলিং বলে।

লোককাহিনী অনুসারে, চিনের সম্রাজ্ঞী শি লিং শি লক্ষ করেন যে তার চায়ের কাপে তুঁত গাছ থেকে একটা কোকুন পড়েছে। 

তিনি এটাকে সরানোর চেষ্টা করার সময় দেখতে পান যে একটা সূক্ষ্ম রেশমি সুতো বেরিয়ে এসেছে। এভাবে রিলিংয়ের উৎপত্তি হয় যে প্রক্রিয়াটা বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের দ্বারা করা হয়।

কোকুনগুলো বিক্রি করার জন্য সেগুলোর ভিতরের পিউপাগুলো বেরিয়ে আসার আগেই সেগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। 

এই কঠিন কাজটা করার জন্য তাপ প্রয়োগ করা হয়। ত্রুটিযুক্ত কোকুনগুলোকে আলাদা করা হয় এবং যেগুলো বাকি থাকে, সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করার জন্য তৈরি থাকে।

সুতা গুলোকে আলগা করার জন্য প্রথমে কোকুনগুলোকে হয় গরম জলে ভিজিয়ে রাখা হয় অথবা বাষ্পীভূত করা হয়। এরপর ঘূর্ণায়মান ব্রাশের দ্বারা সুতার প্রান্তগুলো সংগৃহীত হয়। 

সুতা কতটা মোটা হবে তার ওপর নির্ভর করে, দুই বা ততোধিক কোকুন থেকে সুতা বের করে পাকিয়ে একটা সুতা বানানো হয়। 

সুতাটা শুকানো হয় এবং একটা রিলের মধ্যে প্যাঁচানো হয়। কাঙ্ক্ষিত দৈর্ঘ্য ও ওজনের লাছি সুতো তৈরি করার জন্য আরেকটা বড় রিলের মধ্যে সেই র-সিল্ক আবারও প্যাঁচানো হয়।

রেশমি সুতা এতটাই নরম ও মসৃণ যে আপনি হয়তো এই কাপড় দিয়ে আলতোভাবে আপনার হাত স্পর্শ করতে চাইবেন। 

পরিশেষ বলা যায় যে রেশমের ইতিহাস অনেক পুরাতন।

Textile BD

Founder and Editor of Textile BD. He is a Textile Blogger & Entrepreneur. He is working as a textile job in Bangladeshi companies.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন